নওগাঁ প্রতিনিধি:
ধান উৎপাদনে বরাবরই এগিয়ে উত্তরের জেলা নওগাঁ। চলতি বোরো মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বেশ উচ্ছ্বাস নিয়ে বোরো আবাদ শুরু করেছিলেন এ জেলার চাষীরা। ধানের চারা রোপণ শেষে বর্তমানে খেতের পরিচর্যায় তাদের ব্যস্ততা বেড়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় ইউরিয়া ও সেচ বাবদ খরচ বেড়ে যাওয়ায় জেলার কৃষকের প্রায় ৮৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে। জেলার ধান-চাল বিশ্লেষকদের তথ্যমতে, চলতি বছর ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৫ হেক্টর জমিতে ধান চাষে সেচ ও সার বাবদ খরচ হবে ২৯৭ কোটি ৮৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। গত বছর প্রায় সমপরিমাণ ১ লাখ ৮৯ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদে সার ও সেচে কৃষকের খরচ হয়েছিল ২১৩ কোটি ১৭ লাখ ৬২ হাজার টাকা। চলতি বছর এ বাড়তি খরচ প্রান্তিক কৃষকের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা সার, ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম সহনীয় পর্যায়ে এনে ধানের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন।জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ও ধান-চাল বিশ্লেষকদের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে নওগাঁ জেলার ১১টি উপজেলায় ১ লাখ ৮৯ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৫ হেক্টর জমিতে ধান লাগানো শেষ হয়েছে। যেখানে জিরাশাইল, কাটারি, সম্পা কাটারি, ব্রি-২৮, ২৯, ৮১, ৮৬, ৮৮, ৮৯, ৯০, ৯২ এবং বঙ্গবন্ধু ধান-১০০ জাতের চারা রোপণ করেছেন চাষীরা। এ পরিমাণ জমিতে সেচ কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে গভীর, অগভীর ও এলএলপি সেচযন্ত্রসহ ৬৩ হাজার ১৬৪টি সেচযন্ত্র সচল রয়েছে। যেখানে ৯ হাজার ৯২২টি বিদ্যুৎ চালিত এবং ৫৩ হাজার ২৪২টি ডিজেল দ্বারা পরিচালিত। এর মধ্যে বিএমডিএ ও আরডিএ’র মাধ্যমে পরিচালিত হয় মাত্র ৪ হাজার ২৮০টি সেচযন্ত্র। বাকি ৬৭ হাজার ৪৪৪টি সেচযন্ত্রই ব্যক্তিমালিকানাধীন। অন্যদিকে এ পরিমাণ জমি আবাদে ৩৫ হাজার ৪৫৬ টন ইউরিয়া, ২১ হাজার ১৭৯ টন টিএসপি/ডিএপি এবং ১৪ হাজার ১৮২ টন এমওপি সারের প্রয়োজন। বিপরীতে ৩৯ হাজার ৭৯৫ টন ইউরিয়া, ৩৯ হাজার ২৭ টন টিএসপি/ডিএপি এবং ১৩ হাজার ৭২২ টন এমওপি সার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কৃষক পর্যায়ে এসব সার সুষ্ঠুভাবে বণ্টনে কাজ করছেন বিসিআইসি অনুমোদিত ১২৭ জন ডিলার এবং বিএডিসি অনুমোদিত ২০৫ জন ডিলার। জেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা যায়, ধানের চারা রোপণ শেষে জমির পরিচর্যায় সেচ ও সার দিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষীরা। তবে সেচ ও ইউরিয়া সারে বাড়তি খরচের জোগান দিতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের। গত বছর বোরো মৌসুমে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৮০ টাকা থাকলেও চলতি বছর ১০৯ টাকা, যা লিটার প্রতি ২৯ টাকা বেশি। এছাড়া গত ৩ মাসে গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে বোরো আবাদে সেচ কার্যক্রমে। বিদ্যুৎ ও ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে চলতি মৌসুমে চাষীদের সেচ বাবদ অতিরিক্ত প্রায় ৮৬ কোটি টাকা খরচ গুনতে হচ্ছে।
অন্যদিকে গত বছর বোরো মৌসুমে প্রতি কেজি ইউরিয়ার দাম ১৬ টাকা থাকলেও বর্তমানে তা ২২ টাকায় কিনতে হচ্ছে,যা প্রতি কেজিতে ৬ টাকা বেশি। ফলে চলতি মৌসুমে সেচ ও ইউরিয়া সারে অতিরিক্ত ৮৬ কোটির ধাক্কা সামাল দিতে হবে জেলার চাষীদের। নওগাঁ সদর উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের সরাইল গ্রামের কৃষক মহসিন বলেন, ‘ধানের বাজার ভালো থাকায় সারের খরচ বাড়লেও এ বছর সাইত্রিশ বিঘা জমিতে বোরো আবাদের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। এরই মধ্যে দফায় দফায় ১৫ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। আবার ডিজেলের দামও অনেক বেশি বাড়ানো হয়েছে। খরচ বেড়ে যাওয়ায় পাম্প অপারেটর বিঘা প্রতি সেচ বাবদ অতিরিক্ত ১১০০ টাকা দাবি করছেন।দেশে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য উৎপাদনে আমরা চাষীরা সরকারকে সহযোগিতা করে যাচ্ছি। অথচ কৃষি খাতে প্রভাব পড়বে এমনটা জেনেও দফায় দফায় সার, বীজ, জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এভাবে উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকলে আগামীতে ধান আবাদ থেকে সরে আসা ছাড়া উপায় থাকবে না।’ বদলগাছী উপজেলার বালুভরা ইউনিয়নের ভঞ্চকোল গ্রামের কৃষক বেলাল হোসেন বলেন, ‘দুই বিঘা জমিতে কাটারি জাতের ধান আবাদ করেছেন। যেখানে জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ১৪ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে সেচ ও ইউরিয়া সারে গত বছরের তুলনায় ২ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ গুনতে হয়েছে। এ বছর মৌসুমের শুরুতেই শ্রমিকের মজুরিও বেশি। তাই বাড়তি খরচের জোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’ মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের কৃষক অরুণ সাহা বলেন, ‘বোরোতে খরচ বেশি হলেও ফলন ভালো পাওয়া যায়। এজন্য পাঁচ বিঘা জমিতে ৪৫ হাজার টাকা খরচ করে জিরাশাইল জাতের ধান আবাদ করেছি। সার, কীটনাশক এবং সেচের খরচ বেড়েই চলেছে। সে তুলনায় ধানের দাম বাড়ছে না। বাড়তি এ খরচের ধাক্কা সামাল দিতে হলে এ বছর প্রতি মণ ধানের দাম সরকারিভাবে কমপক্ষে ১ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করে দিতে হবে।’
সদর উপজেলার বালিয়াগাড়ী ও দুবলহাটি গ্রামের সার পরিবেশক ওয়াসেফ আলী মোল্লা বলেন, ‘এ বছর সারের সংকট নেই। মৌসুমের শুরু থেকেই প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত সার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা আমাদের প্রয়োজন ছিল না। এ কারণে লোকসান গুনতে হচ্ছে ডিলারদের। সরকারের উচিত অসময়ে বরাদ্দ না বাড়িয়ে সংকটাপন্ন মুহুর্তে সরবরাহ কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখা।’ রাণীনগর উপজেলার বড়গাছা ইউনিয়নের দেওলা গ্রামের বিএমডিএর অগভীর নলকূপ অপারেটর মিঠু কুমার প্রামাণিক বলেন, ‘আমার নলকূপের আওতায় বর্তমানে ৩৬ বিঘা জমি রয়েছে। বোরো মৌসুমে চার মাস জমিতে সেচ দিতে হয়। গত বছর প্রতি বিঘা জমিতে সেচ বাবদ চাষীদের থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা করে নিয়েছি। এ বছর বিদ্যুতের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমাদের খরচ বেড়ে গেছে। তাই বিঘাপ্রতি ২ হাজার ৫০০ টাকা আদায়ের চেষ্টা চলছে।’ নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা একেএম মনজুরে মাওলা বলেন, বর্তমানে বাজারদর ভালো থাকায় প্রতি বছর ধান আবাদের চাষীদের আগ্রহ বাড়ছে। তাই সেচ-সারে খরচ কিছুটা বাড়লেও এখন পর্যন্ত ধান রোপণের লক্ষ্যমাত্রায় কোনো প্রভাব পড়েনি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এরই মধ্যে আমাদের বোরো ধান রোপণের লক্ষমাত্রা পূরণ হওয়ার পথে। রোগবালাই বা পোকামাকড়ের আক্রমণও নেই। বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে। চাষীদের এ বছরের বাড়তি খরচ সমন্বয় করে ধানের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে দিলে এ সংকট কেটে যাবে।